মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০৮:২৭

শিক্ষা খাতের এক বছর

মাহফুজুর রহমান মানিক
শিক্ষা খাতের এক বছর

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিলেও শিক্ষায় স্বাভাবিক পরিবেশ আসতে বেশ সময় লাগে। ৫ আগস্টের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। একযোগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এমন পদত্যাগ ছিল নজিরবিহীন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে এক বছরে শিক্ষায় স্থিতিশীলতা আনা ও রুটিন দায়িত্ব পালনেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অনেকে শিক্ষার মান বৃদ্ধি, শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোসহ অনেক স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন। বাস্তবে সরকার সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

জুলাই মাসেই আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যুক্ত হতে না পারে। অবশেষে ১৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়। তবে তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শুরুতেই এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল আন্দোলনের মুখে পড়েন। পরীক্ষা বাতিল করে সরকার অটোপাসের যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা স্বাভাবিকভাবেই দূরদর্শী ছিল না। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে প্রণীত শিক্ষাক্রম বাতিল করে পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যায়। সরকার যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও শীর্ষ প্রশাসনিক পদগুলো খালি হওয়ায় সেখানে নতুন উপাচার্য ও অন্যান্য পদে যোগ্যদের বসানোর চেষ্টা করেছে; পাঠ্যপুস্তক ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। জানুয়ারির মধ্যেই সব বই পাওয়ার যে প্রত্যাশা ছিল, সেই বই পেতে মার্চ মাসের অর্ধেক সময় পার হয়ে যায়।

সরকারের প্রথম দিকের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দাবিদাওয়া আন্দোলনের প্রভাব ছিল। বণিক বার্তায় ১০ ফেব্রুয়ারি ‘ছয় মাস ধরে শিক্ষা খাতের বড় সিদ্ধান্তগুলো মবকে ঘিরে’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষা বাতিল, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিল ও সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্তের বিষয় উল্লেখ করা হয়। তা ছাড়া নিবন্ধিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের দাবি মানাসহ আন্দোলনের মুখে সরকারকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। অতীতে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে শিক্ষা নিয়ে যেভাবে নানা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, সেই প্রবণতা অন্তর্বর্তী সরকারও এড়াতে পারেনি।

শিক্ষা প্রশাসন ও নীতি নির্ধারণে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা আগে যেমন উপেক্ষিত ছিলেন, বর্তমান অবস্থাও তথৈবচ। শিক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য রয়েছে ব্যাপকভাবেই। এর আগে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা বাতিল করা হলেও হঠাৎ সেই পরীক্ষা সরকার ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষার অংশীজন এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে এই বৃত্তি পরীক্ষা থেকে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়া এবং তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আরেকটি সংকটের জন্ম দিয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে সময়ের কাজ সময়ে করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের দোদুল্যমানতাও স্পষ্ট। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটে দীর্ঘ পাঁচ মাস অচলাবস্থা বিরাজ করার পর সম্প্রতি শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর সমাধান জরুরি ছিল। সাত কলেজ সমস্যার সমাধান করতেও সরকারকে দীর্ঘ সময় পার করতে হয়েছে। সম্প্রতি আমরা জেনেছি, সাত কলেজের জন্য ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ হবে। যেখানে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে, বাকি ৬০ শতাংশ ক্লাস সশরীরে। এ বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবে কবে চালু হবে, তার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এক বছরে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক অনেক কাজ করেছে। সম্প্রতি দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করেছে। তা ছাড়া এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে পেশাদারিত্বের ওপর জোর দিয়েছে। যদিও এর ফলে ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এ ধারা বজায় থাকলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে এবং শিক্ষার মানও বাড়বে। অবশ্য এত অধিক ফেলের হার চিন্তার বিষয়; একে এড্রেস করা দরকার।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্রলীগের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়েছে। দৃশ্যত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যদিও শিক্ষাঙ্গন থেকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির অবসান ঘটেছে কিনা, স্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে ডাকসু, রাকসু ও জাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; সহাবস্থান ও সমতল মাঠের বিষয়টি তখন স্পষ্ট হবে।

১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা কমিশন গঠন না করায় প্রশ্ন উঠছেÑশিক্ষা সরকারের কতটা অগ্রাধিকারে আছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে এ খাতের সব সমস্যা চিহ্নিত হবে এবং সমাধানের অন্তত সুপারিশ পাওয়া যাবে। তা হয়নি। এমনকি এবারের বাজেটেও শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থেকে গেছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপি হিসেবে বাড়ানোর জোর দাবি থাকলেও এবার উল্টো কমেছে।

বস্তুত সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে এমন কোনো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যে উদ্যোগের ফলে পরবর্তী সময়ে সরকারকে ইতিবাচকভাবে স্মরণ করা যাবে। পরিস্থিতি সেই রবীন্দ্রসংগীতের চরণের মতো: ‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি’। অবশ্য বাকি যে সময় আছে, সরকার চাইলে সেই সদিচ্ছা দেখাতে এবং প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক কিছুটা হলেও ঘোচাতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়