শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

আধুনিক বরিশালের নির্মাতা ও ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা অশ্বিনী কুমার দত্ত
অনলাইন ডেস্ক

বঙ্গভঙ্গ হতে স্বদেশী আন্দোলন, এরপর স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন যে ক’জন বাঙালি তাদের মধ্যে অশ্বিনী কুমার দত্ত অন্যতম। এই কৃতীপুরুষ ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি পটুয়াখালী মহকুমার লাউকাঠিতে জন্ম নেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস গৌরনদীর বাটাজোড় গ্রামে। বাবার নাম ব্রজমোহন দত্ত ও মা প্রসন্নময়ী দেবী। জানা যায়, দত্ত পরিবারের আদি পুরুষ পুরুষোত্তম দত্ত মহারাজা আদিশুরের সময় বাংলাদেশে আগমন করেন। তার অধীনস্থ ভৈরব দত্ত বলালী কৌলিন্য লাভ করে প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের বাটাজোড়ে বসতি স্থাপন করেন। ভৈরব দত্তের বংশধর গতিনারায়ণ দত্ত অশ্বিনী কুমারের প্রপিতামহ।

অশ্বিনী কুমার দত্ত যখন জন্ম নেন তখন ব্রজমোহন দত্ত পটুয়াখালীর মুন্সেফ। মা-বাবার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ শিশু অশ্বিনী কুমারের ওপর বাল্যকাল থেকেই প্রভাব বিস্তার করে। তিনি বাড়িতেই গোমস্তা নীল কমল সরকারের কাছে তালপাতায় বর্ণমালা শেখা শুরু করেন। এছাড়াও বাবার চেষ্টায় বিভিন্ন জায়গায় লেখাপড়া করেন। ১৮৬৯ সনে তিনি ঢাকা থেকে প্রবেশিকা পাস করে মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৭১ সনে কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। ১৮৭২ সনে বিএ পড়ার সময় তিনি বরিশাল মহকুমার নলছিটির নথুলাবাদের মীরবহর পারিবারের কায়স্থ কন্যা সরলা বালাকে বিয়ে করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮০ সনে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং ১৮৮২ সনে বিএল পাস করেন অশ্বিনী কুমার। বাবার কাছে ধর্ম চর্চা, সংস্কৃত ও ফার্সি শিক্ষালাভ করেন তিনি, আর এলাহাবাদে কিছুদিন ওকালতি করেন।

সমাজের কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচিও পরিচালনা করেন। বরিশালে বিভিন্ন সমাজহিতৈষী ও কল্যাণমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজকর্মের জন্যে তাঁকে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার বা আধুনিক বরিশালের রূপকার বলে অভিহিত করা হতো। দুর্নীতি, সামাজিক গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। দুর্ভিক্ষে অতুলনীয় সেবাকাজে, চা বাগান শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, ক্লান্তিহীন নেতা। চারণকবি মুকুন্দ দাস ও রাজনীতিবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হকের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর সর্বাত্মক অবদান ছিল।

বরিশাল শহরে নিজের দান করা এলাকায় ১৮৮৪ সনের ২৭ জুন বাবার নামে ব্রজমোহন স্কুল এবং ১৮৮৯ সনের ১৪ জুন দক্ষিণাঞ্চলের অক্সফোর্ড খ্যাত ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে কুড়ি বছর বিনা বেতনে কলেজে শিক্ষাদান করেছেন। তিনি বরিশাল শহরে নারী শিক্ষার্থে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও ১৮৮৬-তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য 'পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন' স্থাপন করেন। ১৮৮৭-তে তাঁর প্রচেষ্টায় বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয়। ১৮৮৭-তেই নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য 'বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা' এবং একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। অশ্বিনী ভবন ভেঙ্গে ফেলার পর নাইট কলেজ তৈরি করা হয়, যা পরে বর্তমান বরিশাল সরকারি কলেজ নামে পরিচিত হয়।

১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় জাতীয় নেতার স্থান লাভ করেন তিনি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের মাদ্রাজ অধিবেশনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন। জাতীয় কংগ্রেসকে প্রাসাদ রাজনীতি থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে নিয়ে আসার প্রথম কারিগর অশ্বিনীকুমার দত্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'স্বদেশ বান্ধব সমিতি'র স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে বরিশালকে স্বদেশী আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই সমিতির জেলার সর্বত্র ১৬০ টিরও বেশি শাখা ছিল । ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে বরিশালে গ্রেপ্তার করে ও ১৯০৮ সালে তাঁর সমিতি নিষিদ্ধ করে। তাঁকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মৌ জেলে বন্দি রাখা হয়। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী প্রথম বরিশালে এসে অশ্বিনীকুমার দত্তকে জেলার অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন। কলকাতায় রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে ব্রাহ্মধর্মে আকৃষ্ট হন ও ১৮৮২-তে বরিশালে ব্রাহ্মসমাজের সদস্যপদ গ্রহণ করেন । তাঁর সব সম্পদ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য দান করে গেছেন । শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান অনন্য।

আশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৬ সনে অবিভক্ত বাংলায় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৮৮৭ সনে লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং তিন বছর তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯০৫ সনে তাঁর নেতৃত্বে বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে রেঙ্গুন ও পরে আগ্রায় বন্দি করে রাখা হয়। মুক্তিলাভের পর তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। বহুমূত্র ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন তিনি। এরপর ১৯২৩ সনের ৭ নভেম্বর ৬৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

লেখক : মোঃ নূর ইসলাম খান অসি, পরিচালক : ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; সভাপতি : বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। মুঠোফোন : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়