রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০৯:২৬

জীবনজুড়ে বাবা

কাদের পলাশ
জীবনজুড়ে বাবা

নাতিশীতোষ্ণ সময়ে পৃথিবীতে আমার প্রথম শ্বাস নেয়া। আমার জন্মের ছয়মাস পর শুরু বাবার প্রবাস জীবন। দু-তিন বছর পরপর বাড়ি আসেন। আমি অবুঝ। বর্ষার এক বর্ষণমুখর দিনে দাদার পুরানো ঘরে পাশের বাড়ির নুরু কাকার সাথে দুষ্টুমিতে আমি মাতোয়ারা। হঠাৎ খোলা দরজায় নজর নিক্ষিপ্ত হয় বাইরে। বাড়ির পুকুরের পূর্ব-উত্তর পাড় হয়ে বাবা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি আসছেন। আমি চিৎকার দিয়ে বলি, কাকা, আব্বা আইতাছে। তিনি কর্ণপাত করলেন না। আমি আবারো বলি, বারবার বলি। কাকা যখন বাইরে নজর দিলেন, ততক্ষণে আব্বা খড়ের পাড়ার আড়ালে পড়ে যান। কাকা ভাবলেন, আমি বোধ হয় নজরবন্দি খেলছি।

আমি নীরব হয়ে পথের দিকে নজর রাখছি। অবুঝ মন, বিপুল উৎসাহ নিয়ে ছোট ছোট পায়ে দরজার চৌকাঠে হাত রাখি। আব্বা দৃশ্যমান হতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিচ্ছে। আমি হতাশায় ডুব দেই, তবে কি আমি ভুল দেখেছি? নিজের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকি। বিশ্বাস করি, আমি ভুল দেখিনি। বাড়ির উঠোনে টানা বৃষ্টিতে সবুজ শ্যাওলা গালিচা পেতেছে। ওই শ্যাওলা এতোটা পিচ্ছিল যে ভাবতেই গা শিরশির করে। সেই শ্যাওলার ওপর যুগল পা যেন টলমল করছে। চোখ উপরে তুলতেই আমার সকল উৎকণ্ঠা মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আমি, আব্বা বলে চিৎকার দিয়ে কাছে চলে যাই। হাতে দুটি বিদেশি ব্যাগ। তারপরেও পরম যত্নে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। উঠোনের পিচ্ছিল শ্যাওলা মাড়িয়ে ঘরে এলেন আমাকে কোলে করেই। এই প্রথম আমি বাবার কোল অনুভব করি।

কয়েকদিনের টানা বর্ষণে বাড়ির উঠোনে পানি জমেছে। সন্ধ্যারাত আব্বা বড়ো জেঠার ঘরে যাবেন। আমিও যাবো বায়না ধরি। কোলে তুলে নিয়ে গেলেন জেঠার ঘরে। এটিই শেষবার বাবার কোলে উঠা। আরেকবার কোলে নিয়ে দু গালে আদর দিয়েছেন। আমি তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। একটু বড়সড় হয়েছি, তাই বেশিক্ষণ কোলে রাখলেন না।

আনুষ্ঠানিক স্কুলের প্রথম দিন। স্কুলের পথে বাবার হাত ধরে হাঁটছি। বাবার মাথায় ওড়া ভর্তি মটর বীজ। তিনি আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মাঠে যাবেন। কিন্তু আমি স্কুলে যেতে ইচ্ছুক না। বাবা অনেক পরে বুঝতে পারলেন। কিন্তু কেন? বলি, গায়ের শার্টটি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট। বাবা টেনেটুনে দিলেন। আমার মনঃপুত হলো না। রাস্তায় সাঁকো পড়লো। পার হতে হবে, বাবা বললেন, স্কুলে না গেলে বাড়ি চলে যা। যেতে পারবি? আমি হুম সূচক মাথা নাড়লাম। বললেন, তবে যা। আমি বাড়ি এসে যাই। আমাদের হায়াৎপুর গ্রামে স্কুল নেই। আজও নেই। পাশের তিন গ্রাম ডিঙ্গিয়ে কবে থেকে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু মনে নেই।

বাবার ছুটি শেষ। কোনো এক কাকডাকা ভোরে আমাকে ঘুমে রেখেই বাবা পাড়ি দিলেন প্রবাসে। আমি মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। স্কুলের পাশেই ডাকঘর। প্রতিদিন দুপুরে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ডাকঘরে যাই। ডাক পিয়নদের কাছে চিঠি বুঝিয়ে দেন পোস্টমাস্টার। যখন ডাক পিয়নকে চিঠি বুঝিয়ে দেন তখন, নাম ঠিকানা পড়েন। আমিও প্রতিটি চিঠির ঠিকানা দেখি। বাবার নাম মো. সোলাইমান মিয়া নামটি চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু অনেক চিঠিই আমার দৃষ্টিগোচর হয় না। ছোট মানুষ ছোট ক্লাসে পড়ি, দ্রুত পড়ে শেষ করতে পারি না। বাবার চিঠির অপেক্ষায় থাকেন মা, আমি এসে চিঠি এসেছে সে খবরটুকু দিতে চাই। এমন প্রাণান্তকর চেষ্টা কয়েকবার সফলও হয়েছে বটে। বাবার চিঠির অপেক্ষা, এখনো আমায় স্মৃতিজোয়ারে ভাসায়। আপ্লুত হই।

মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আমি। গায়ে গোতরে বড় হয়েছি। অভিমানে আমিও প্রবাসে চলে যাবো সিদ্ধান্ত নেই। বয়স ষোলো, চব্বিশ বয়স দিয়ে পাসপোর্ট করি। বাবা আমার জন্যে কুয়েতের ভিসা নিয়ে তার ভিসা ক্যানসেল করে চলে এলেন।

আমার প্রবাস জীবন (৭ ডিসেম্বর ২০০৩-১ ডিসেম্বর ২০০৬)। জেডটার্ন করে আবার পড়ালেখা শুরু। ২০০৭ সাল থেকে গ্রাম থেকে ছোট্ট শহরে অবস্থান। পড়ালেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা। দুটোই চললো পুরোদমে। বাবার কাছে আর থাকা হলো না। কিন্তু স্বশিক্ষিত বাবার কর্মস্পৃহা ও অনুপ্রেরণা আমায় তুমুলভাবে জড়িয়ে নিলো।

আমার জীবনজুড়ে বাবা। এমন গল্প বলতে গিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক নয়। বলতে চেয়েছি, আমি বাবার সান্নিধ্য পেয়েছি কতোটা সময়? যা অতি নগণ্য। কিন্তু আমার বাবা কতোটা পরিশ্রমী তা আমি টের পেয়েছি যখন তার শরীরের ঘ্রাণ আমি মনে করতে পারি না। ঘ্রাণ কেমন জানি না। মা ও চার ভাইবোনের দায়িত্ব। সর্ব কনিষ্ঠ হওয়ায় হয়তো বাবার কাঁধে দায়িত্ব বড়ো হয়েছে। বাবা আমার সৎ ও পরিশ্রমী। গ্রামের মানুষ সম্মান করে। তাঁর প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসায় আমিও অনুপ্রাণিত হই। জীবনে ভালো মানুষ হওয়া চাই। মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে প্রাণান্তকর চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি নেই।

প্রকৃত অর্থে আমার জীবনে বাবাকে কাছাকাছি পেয়েছি অল্প কয়েকদিন। বাবার খালি বুকে গড়াগড়ি খেলেও তা বিস্মৃত। তাই বাবাকে নিয়ে আমার স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ নয়। তবে বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, সঞ্চয়ের মানসিকতা, সৎ থাকার কৌশল আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমিও ছোট বেলা থেকেই অনেক পরিশ্রমী-সঞ্চয়ী। পরিশ্রমী মানুষ দেখলে আমার ভালো লাগে। ছেলেবেলায় মা আমায় বলতেন, আমার শারীরিক কাঠামো ঠিক বাবার মতো। আমিও বাবার মতো হতে চেষ্টা করতে থাকি। এ চেষ্টা বাবা আমার বুঝতে পারেন। অন্য কেউ সেটা বোঝেন না। আমাকে বাইরের অনুমান করে হিংসা করেন, ক্ষতি করার অপপ্রয়াস চালায়, আমি ওতে পাত্তা দেই না। বরং আমি আমার কাজটুকু করে যাই, করে যেতে চাই। কী পেলাম কী পেলাম না তার হিসেব মেলাতে কখনো চাই নি, চাইবোও না।

কাদের পলাশ : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও লোকগবেষক; মহপরিচালক, সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়