শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৫, ০২:২৬

ফরিদপুরে ভাড়া বাসা থেকে নারীর বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার: পরকীয়া, প্রতারণা না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?

“মা মরেছে, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম” — অচেতন শিশুকন্যার পাশে পড়ে ছিল রিনার নিথর দেহ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, মো.জাকির হোসেন
ফরিদপুরে ভাড়া বাসা থেকে নারীর বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার: পরকীয়া, প্রতারণা না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
ছবি : সংগৃহীত

ফরিদপুর শহরের রঘুনন্দনপুর এলাকায় এক ভাড়া বাসা থেকে রিনা বেগম (৩০) নামের এক নারীর রহস্যজনক বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা জেলায়। মৃত্যুর কারণ, সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ড, এবং এক রহস্যময় পুরুষের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—এটা কি পরকীয়ার জেরে ঘটে যাওয়া একটি নির্মম খুন, না কি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যা?

ঘটনাস্থল: হাবিব ভিলার নিচতলা, রঘুনন্দনপুর

ঘটনা ঘটে মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে। স্থানীয়রা জানান, হাবিব ভিলার নিচতলার ভাড়া বাসা থেকে টলমলে পানি বের হতে দেখে সন্দেহ হয়। দরজার কলিং বেল বারবার চাপলেও ভেতর থেকে সাড়া না পাওয়ায় তারা কোতয়ালী থানা পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে বাথরুমের সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় রিনা বেগমের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে। পাশের কক্ষে অচেতন অবস্থায় ছিল তার পাঁচ বছরের একমাত্র শিশুকন্যা।

নিহত রিনার পরিচয় ও অতীত জীবন

নিহত রিনা বেগম ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের আজহার মন্ডলের ডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১৫ বছর আগে তার বিয়ে হয় ঈশানগোপালপুর ইউনিয়নের শহীদ মোল্লার সঙ্গে। বিয়ের পরের দুই বছরে স্বামী শহীদ মোল্লা সৌদি আরব পাড়ি জমান। কিছুদিন পর স্ত্রী রিনাকেও সেখানে নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক বছর আগে রিনা দেশে ফিরে আসেন।

দেশে ফেরার পর রিনার সঙ্গে মনিরুল ইসলাম (৪০) নামে এক ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই মনিরুলই নিজেকে রিনার স্বামী পরিচয় দিয়ে চলতি মাসের শুরুতে হাবিব ভিলার বাসাটি ভাড়া নেন। রিনা এক সপ্তাহ আগে সেখানে ওঠেন।

ঘটনাস্থলের চিত্র

ঘরের ভেতরে বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল—ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খাবার ও ওষুধ, অগোছালো বিছানা এবং বাথরুমের সামনে বিবস্ত্র দেহ। শিশুকন্যাকে উদ্ধারের পর দ্রুত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে স্থিতিশীল ঘোষণা করেন। তবে ট্রমার কারণে সে কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই।

রহস্যমানব মনিরুল ইসলাম

রিনার সঙ্গে থাকা মনিরুল ইসলাম ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ। পুলিশ জানায়, ঘটনার খবর পাওয়ার পর তাকে ফোন করা হলে তিনি আর ফোন ধরেননি এবং পরবর্তীতে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

বাড়ির মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, “মনিরুল নিজেকে রিনার স্বামী পরিচয় দিয়েই বাসা ভাড়া নেয়। ভাড়ার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখছি, সে পুরো বিষয়টাই গোপন করেছে।”

পুলিশের বক্তব্য

কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান জানান, “ঘটনাটি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”

সন্দেহের দিকগুলো:

  • রিনার বিবস্ত্র দেহ — যা সম্ভাব্য শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের ইঙ্গিত দিতে পারে।
  • অচেতন শিশু — কীভাবে সে অচেতন হলো? খাবারে কি কিছু মেশানো হয়েছিল?
  • মনিরুলের উধাও হওয়া — ঘটনার সঙ্গে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা নিয়ে জোরালো সন্দেহ।
  • ভাড়াটিয়া তথ্য গোপন — বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় দেয়া তথ্য ভুয়া কিনা তা যাচাই করছে পুলিশ।
  • ঘরের ভেতরের ওষুধ — আত্মহত্যার প্রবণতা, না কি জোর করে কিছু খাওয়ানো হয়েছিল?

প্রতিবেশীদের ভাষ্যে

এক প্রতিবেশী বলেন, “মহিলাটিকে আমরা খুব চুপচাপ স্বভাবের বলেই জানতাম। ওদের মাঝে যে কোনো সমস্যা ছিল, আমরা টের পাইনি। হঠাৎ এমন মৃত্যু, তাও আবার এই অবস্থায়—আমরা ভীষণ আতঙ্কিত।”

সমাজ বিশ্লেষকের মতামত

অধ্যাপক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সমাজ গবেষক বলেন, “এখানে নারী নিরাপত্তাহীনতা, পুরুষের প্রতারণা, এবং আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতাই দায়ী।” এমন ঘটনায় নারীর চরিত্র হেয় না করে সমাজ ও আইনের ব্যর্থতাই বেশি আলোচনায় আসা উচিত।

রিনা বেগমের মৃত্যু নিছক আত্মহত্যা, না কি নির্মম হত্যাকাণ্ড—তা নির্ধারিত হবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও পুলিশি তদন্তে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা ও নারী অধিকার রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে, যদি অপরাধী দ্রুত চিহ্নিত ও শাস্তির আওতায় আনা হয়।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়